কালো কালির শিরোনাম
সন্ধ্যার আকাশ।
এখনো রক্তিম।
সমুদ্রতটে একা একা হাঁটছে নিরু। নানান ভাবনায় পাড় হচ্ছে তার সময়গুলো।
– কিরে নিরু, তুই এখানে!
পরিচিত কণ্ঠে সারা দিয়ে পিছু ফিরে তাকাতেই,
– আরে তারেক নাকি! দোস্ত, কোথা থেকে আসলি? কতদিন পরে তোর সাথে দেখা। নিজের চোখকে যে বিশ্বাস করতে পারছি না।
– কেমন আছিস?
– ভালো। তুই?
– এইতো আছি আরকি, গাধার মত।
– পুরনো কথা এখনো বর্তমান?
– অতীত হবে অচিরেই। সব ছেড়ে দেবো।
– পারবি তো?
– পারবো… চল, সামনে এগিয়ে যাই।
তারেক নিরুর বন্ধু। ওসমান স্যারের বাসায় থেকে নবম আর দশম শ্রেণি পাড়ি দিয়েছে একসাথে। এস.এস.সি পরীক্ষার পরে আর দেখা হয়নি পরস্পরের। বহুদিন পর আজ দুজন দুজনকে পেয়ে খুব খুশি।
উপকূলে একসাথেই হাঁটছে দুজন। বর্তমান জীবন নিয়ে কথা হচ্ছে দুজনের মাঝে। সবশেষে তারেক নিরুকে জিজ্ঞেস করলো,
– কোথায় উঠেছিস?
– উঠিনি, রাতে উঠবো।
– উঠতে হবেনা, আমার সাথে চল।
– কোথায়?
– গেলেই বুঝতে পারবি।
নিরু তারেকের সাথে একটা আবাসিক হোটেলের সামনে গেল। উপকূল থেকে একটু দূরেই হোটেলটার অবস্থান। নিরুকে দূরে দাড় করিয়ে হোটেলের ম্যানেজারের সাথে কথা বলছে তারেক। কথা শেষে দ্বিতীয় তলায় উঠলো দুজন। তারেক নিরুকে বলল,
– এই নে তোর ঘরের চাবি।
– সেকি, তুই থাকবি না আমার সাথে?
– নাহ, তোদের মাঝে থেকে আমি কি করবো?
– আমাদের মাঝে আরেকজন পেলি কোথায়?
– রাত হলে আরেকজন আসবে।
– কে?
– নিশিগন্ধা।
– আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করেছিস? আমি যে এসব পছন্দ করি না, সেটা তো তুই ভালো করেই জানিস।
– জানি, তবে স্বল্প সময়ের জীবনে নিজেকে এভাবে আর কত বেঁধে রাখবি?
– আমি চলে যাবো।
– তবে যে আমাকেও যেতে হবে।
– তাহলে আর দাঁড়িয়ে কেন? চল।
– না।
– আবার না কেন?
– আমাকে আজ এখানে থাকতেই হবে।
– কেন?
– পরে সব বলবো। তাছাড়া এখানকার রাতের পরিবেশটাও ভালো না। সমস্যা কি, একটা রাতের ব্যাপার মাত্র।
– তবে শুনে রাখ… আমার কাছে কেউ গেলে তোর খবর আছে, মনে রাখিস।
নিরু চলে গেল তার ঘরে।
রাত গভীর হতেই তার দরজা থেকে কারো টোকার আওয়াজ এলো। দরজা খুলতেই এক মেয়ে তড়িঘড়ি করে তার ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
– কে আপনি?
– বুঝতে কষ্ট হচ্ছে?
– বুঝতে চাইনা, বেড়িয়ে যান। আপনাকে আমার প্রয়োজন নেই।
– সুযোগ নেই।
– মানে?
– সব কামরা বুকিং হয়ে গেছে। আমাকে এখানেই থাকতে হবে।
– লজ্জা করেনা?
– সেটা অনেক আগেই হারিয়েছি।
একথা বলে বিছানার একপাশে বসে পড়লো মেয়েটা।
– আমি এসবে অভ্যস্ত না। আমাকে মুক্তি দিন।
– পারবো না। মা অসুস্থ, টাকা লাগবে।
– আপনার মত সকলেই এরকম মিথ্যা বলে।
– আমার গল্পটা ভিন্ন।
– এসব গল্পের ভিন্নতা খুব কম।
– সেই কমের মাঝে আমি একজন।
– কি ভিন্নতা আছে আপনার গল্পে?
– বাদ দিন। আমারটা অনেক পুরনো গল্প, যার মাঝপথে আমার বর্তমান অবস্থান। এ গল্প শুনে লাভ নেই। শুনলে আপনি আমাকে মিথ্যাবাদী ভাববেন।
– ভাববো না।
– আমার গল্পের শুরু হয়েছিল একটা ধর্ষিতা চরিত্রের লাইন ধরে, যে লাইনগুলোর পুরোটাই এখন বিলুপ্ত।
– পুরো গল্পটা আমি শুনবো।
– সারারাত ফুরিয়ে যাবে।
– যাক না, ক্ষতি নেই।
– ক্ষতি তো আছেই, অযথাই আপনার টাকা কেন নষ্ট করবেন? তার চেয়ে কড়ায়গণ্ডায় উশুল করে নিন।
– এভাবে কেন বলছেন?
– কিভাবে বলবো তবে? আমাদের মত কালো জগতের মানুষের কাছ থেকে সাদা কথা বের হয়না। বের হলেও তার শুনবার মত সহ্যক্ষমতা আপনার মত সাধুদের নেই।
– আমি সাধুও নই, ভণ্ডও নই।
– আপনারা সাধুই। কোন পরনারীর দিকে আপনারা তাকান না। তবে অন্ধকারে আপনাদের মুক্ত হাত দুটো তাদেরই কাছে গচ্ছিত থাকা লোভনীয় কিছু একটা খুঁজে বেড়ায়।
– আমি আপনাদের মতো মানুষদের সান্নিধ্য পাবার জন্য এখানে আসিনি।
– গল্প শুনতে এসেছেন?
– না। আমার বন্ধুর সাথে এসেছি। ও অন্য ঘরে আছে হয়তো।
– আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?
– না।
– তবে আসুন। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।
– না।
– দেখুন, আমার টাকা লাগবেই। তাতে আপনি আমার কাছে আসুন আর না-ই আসুন।
– আমি পুরোটাই শোধ করে দেবো।
– এমনিতেই?
– হ্যাঁ।
মেয়েটা অবাক হল। একটা মেয়েকে এভাবে একা এক ঘরে পেয়েও তার থেকে কিছুই চাইছে না। সত্যিই আজব মানুষ। নিরুর আচরণে অনেকটাই মুগ্ধ সে।
– কি হল, বলবেন না আপনার গল্পটা?
– বাবা নেই। বড় কোন ভাইও নেই আমার। অসুস্থ মায়ের সামনেই নরপশুদের কালো থাবায় জর্জরিত হয়েছি। আর্তনাদ শুনেও কেউ রক্ষা করতে আসেনি। তাদের বিরুদ্ধে সমাজের কেউ কথা বলেনি। বিচার চেয়ে আমি আর আমার মা দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। সেখানেও একই রকম মানসিকতার কতগুলো মানুষরূপী জীব। বিবেকহীন বিনিময়ের কাছে হার মানিনী বলে সুবিচার পাইনি। অসহ্য ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর আমার মায়ের খাবার জোগাড় করতে উঁচু শ্রেণীর কিছু জীবের দারস্থ হয়েছি। নির্মম সত্যের দোহাই দিয়ে তারা দূর থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছে। ক্ষুধাতুর মায়ের বিষ-জ্বালার কোন সমাধান পাইনি। ঝিয়ের কাজ করতে গিয়েছিলাম। সেখানেও কর্তার লোলুপ দৃষ্টির আড়াল হতে পারিনি। অসহায় আত্মসমর্পণ শেষে মুখ লুকিয়ে চলে এসেছি। মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে একটি চাকরির আশায় অনেক ঘুরেছি। লোভনীয় শর্ত না মানায় কোথাও ঠাঁই হয়নি। এদিকে অসুস্থ মা অসহ্য যন্ত্রণায় হাসপাতালের বারান্দায় কাতরাচ্ছে। সহায়হীন হয়ে যখন রাস্তায় হাঁটছি, আপনাদেরই মত কয়েকজন আমাকে জোর করে তাদের গাড়িতে করে এখানে নিয়ে এলো। অন্ধকার জগত আরও ঘন কালো হল। চোখ খুলতেই নতুন এক অজানা অসভ্য পৃথিবী আমার সামনে। বিবেকবান মানুষের সমাজ থেকে একটু দূরে। এখানে ঘন কালো অন্ধকার। একবার আসলে হারিয়ে যায় ফিরে যাওয়ার রাস্তা। আর এখানেই আমার বসবাস। এই জগতে আমি প্রসিদ্ধ। তবে, আপনাদের লোকসমাজে আমি নিতান্তই একজন পতিতা।
– আপনাকে পতিতা বললে ভুল হবে।
– ভুল হবে কেন? আপনাদের স্বঘোষিত বিবেকবান সমাজই আমাকে পতিতা বানিয়েছে। আপনাদের তো ভুল হবার কথাই না।
– আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি।
– সবাই তো আর আপনি না। যারা এখানে আসে, কারো টাকাই তারা বিফল হতে দেয় না। উশুল করে নেয়।
– ওরা আপনার সম্পর্কে কিছু জানেনা।
– জানতে চাইলে তো জানবে… আমি শুধু কালো কালিতে লেখা অন্ধকার জগতের লোভনীয় শিরোনাম। প্রয়োজনই হয়না পটভূমি জানার বা বিশ্লেষণ করার। ভেবেছিলাম, পৃথিবী থেকে শেষ ঠিকানায় স্থানান্তরিত হবো। কিন্তু সেখানেও আমি ব্যর্থ, অসহায়। শেষ ঠিকানায় পাড়ি দেয়ার পথটি আগলে রেখেছে মৃত্যুর সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাওয়া আমার অসুস্থ গর্ভধারিণী মা।